৮:৩০ পিএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সোমবার |
| ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪০
এন এ খোকন, সাতকানিয়া থেকে ফিরে : চারদিকে ফুল আর ফুল। বিস্তৃত খেতজুড়ে ছড়িয়ে গেছে রং- লাল, সাদা, হলুদ। ছিল আলুর রাজ্য, এখন ফুলের সুবাস। গ্রামটির নাম চরখাগরিয়া।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার চরখাগরিয়া ইউনিয়নের এই গ্রামটি এখন পরিচিতি পেয়েছে ফুলের গ্রাম হিসেবে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য এলাকার ফুলের চাহিদা মেটাচ্ছেন এখানকার চাষিরা। ব্যবসাও বাড়ছে দিন দিন। শুধু শীত মৌসুমেই বিক্রি হয় কোটি টাকার ফুল।
আশায় বসতি মানুষের। ফুলে বদলাবে দিন। একজনের দেখাদেখি মাঠে নামছেন আরেকজন। বাড়ছে চাষ, বাড়ছে চাষি। সবে সকালের আমেজ কাটছে। তেতে উঠেছে রোদ। তবে সূর্যের চোখ রাঙানি কাবু করতে পারছে না এক দল মানুষকে। রাজ্যের ব্যস্ততা তাঁদের। কথা বলারও সময় নেই।
ফুল চাষ করে বদলে গেছে অনেকের দিন। আলু চাষে লোকসান দিয়ে শেষে ফুল দিয়ে ফিরেছে সুদিন। এ রকম একজন মোহাম্মদ আব্দুর রহিম। তার খেতজুড়ে ফুটে আছে গ্লাযাডিওলাস, গাঁদা, জিপসি, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, সিলসিলা ও রজনীগন্ধা। বিচিত্র রঙের ছড়াছড়ি। চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ফুল সরবরাহ দিচ্ছেন তিনি। নিজে পাঁচ কানি জমিতে চাষ করছেন। মাসে তাঁর আয় লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকার পুরোপুরি চাহিদা মেটাত যশোরের ফুল। এখন সেখানে ভাগ বসিয়েছে চরখাগরিয়া। প্রায় ২০ শতাংশ ফুল সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে এখান থেকে।
আলুর চেয়ে লাভ বেশি হওয়ায় বেশির ভাগ চাষি ঝুঁকে পড়েছেন ফুল চাষে। ফুল চাষ করে কাউকে এখনো লোকসান গুনতে হয়নি। শুধু তা-ই নয়, যাঁরা একসময় দাদন নিয়ে আলু চাষ করতেন, তাঁদের এখন ঋণের বোঝা নেই। বর্ষা ছাড়া বছরের অন্য সময়ে ফুল চাষেই মন দেন তাঁরা।
আলুর খেত গেল ফুলের দখলে । এখন ৮০ শতাংশ বাসিন্দা ফুল চাষ ও এর ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে জুন পর্যন্ত চলে চাষ। মাঝখানে দুই মাস বিলে পানি থাকায় চাষ বন্ধ রাখতে হয়।
চাষিরা জানান, এখানকার ফুল যাচ্ছে চট্টগ্রাম শহরের চেরাগীপাহাড়, কক্সবাজার, পার্বত্য তিন জেলা—খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি, আমিরাবাদ, চকরিয়া, হাটহাজারী ও রাঙ্গুনিয়ায়।
ফুল চাষি নুর মোহাম্মদ জানান, গ্রামের পুরো এলাকা জুড়ে ফুল চাষ করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন অনেকে। তিনি বলেন, এক সময় সবজি চাষ করতাম। সবজিতে লাভের মুখ না দেখে ঝুঁকে পড়েছি ফুল চাষে। ২২ গন্ডা জমিতে ফুল চাষ করেছি। এতে বছরে সব খরচ বাদ দিয়ে ৫০-৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ থাকে। আগে সংসারে লেগে থাকতো অভাব। ফুল চাষ করার পর থেকে আল্লাহর রহমতে অভাব জিনিসটা বুঝতে পারিনি।
চরখাগরিয়ার ফুলচাষি আবদুল গফুরের দাবি, ১৯৯১ সালের দিকে তাঁর বড়ভাই আবদুল মোতালেবের হাত ধরে খাগরিয়ায় ফুলচাষের যাত্রা শুরু হয়। তিনি ১৯৮৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন। পরিবারের অভাবের তাড়নায় পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করে চট্টগ্রামে একটি নার্সারিতে কাজ নেন। কিন্তু চাকরির বেতন দিয়ে বাবা-মা ও ভাই-বোনসহ ১২ জনের সংসারের চাকা ঘুরছিল না। অভাব লেগেই থাকত। কয়েক বছরের চাকরিতে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে গ্রামে ফিরে নেমে পড়েন ফুলচাষে। মোতালেব মাত্র ২০ শতক জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ শুরু করেন। প্রথম বছর ভালো লাভ হয়। পরের বছর থেকে ফুলচাষের পরিমাণ বাড়ান। অন্যান্য ফসলের চেয়ে অধিক লাভজনক হওয়ায় পরিবারের সবাই ফুলচাষের দিকে মনোযোগ দেন। এর পর থেকে আর পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। ফুলচাষে রাঙিয়ে যায় তাঁদের জীবন। পরিবারের সবাই মিলে ফুলচাষ করে ফিরিয়েছে সুদিন।
আবদুল গফুর বলেন, ‘শুরুর দিকে ফুল বিক্রির জন্য চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে যেতে হত। অনেক সময় সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হতাম। ফলে এভাবে কয়েক বছর যাওয়ার পর খাগরিয়ায় উৎপাদিত ফুলকে পুঁজি করে চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড়ের মোড় এলাকায় নিজেরাই স্টার পুষ্প বিতান নামে একটি দোকান দেই। আমাদের উৎপাদিত ফুলের পাশাপাশি অন্য জায়গা থেকে ফুল এনে ব্যবসা শুরু করি। বছরের পর বছর ফুলচাষ বাড়াতে থাকি। পরে আরো একটি দোকান দেই। ’ ‘কেটে গেছে আমাদের দুর্দিন। এক সময় অভাবের তাড়নায় ঠিকভাবে লেখাপড়া করতে পারিনি। এখন আর অভাব নেই। ফুলচাষ পুঁজি করে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি। এখন পাকাবাড়ি, গাড়ি, জমি সব হয়েছে। সব ভাই-বোনের বিয়ে হয়েছে। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছি। ’
যোগ করেন গফুর। তিনি জানান, চলতি বছর তাঁরা প্রায় ২০ কানি জমিতে ফুলচাষ করেছেন। ভবিষ্যতে আরো জমিতে ফুলচাষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। জানা গেছে, বর্তমানে সাতকানিয়ার চরখাগরিয়া এবং চন্দনাইশের জাফরাবাদে প্রায় ৩০০ কানি জমিতে ফুলচাষ হয়।
চরখাগরিয়ার ওয়ালিপাড়ার সিকদারবাড়ির ফুলচাষি জাহাঙ্গীর আলম জানান, আট বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান। বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। সৎ মায়ের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে প্রথমে নার্সারিতে, পরে ফুলের দোকানে চাকরি নেন। আট বছর আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ির পাশে খাজনা দিয়ে জমি নিয়ে ফুলচাষ শুরু করেন তিনি। প্রথম বছর মাত্র আট শতক জমিতে ফুলচাষ করে প্রায় ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়। পরে ফুলচাষ বাড়াতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘এ বছর দুই কানি জমিতে ফুলচাষ করেছি। ফলনও খুব ভালো হয়েছে। ’
ফুলচাষিরা জানান, পুরো খাগরিয়া ইউনিয়নে কম বেশি ফুলচাষ হয়। তবে চরখাগরিয়ার প্রায় প্রতিটি পরিবার ফুলচাষে জড়িত। এখানকার কয়েক শ পরিবার ফুলচাষ করে। যেসব পরিবার ফুল চাষ করে না তাঁরাও নানাভাবে ফুলের সাথে জড়িয়ে আছেন। এমনকি স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েরাও অবসরে ফুল ছেঁড়া, মালা গাঁথাসহ নানা কাজে সহযোগিতা করে। ফুলচাষ চর খাগরিয়ার মানুষের অভাব দূর করে দিয়েছে। স্বাবলম্বি হয়ে ওঠেছে প্রায় পরিবার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে এখানকার ফুলের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। পহেলা বৈশাখ, থার্টি ফার্স্ট নাইট, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর ও ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় ও বিশেষ দিবসে ফুলের দাম খুব ভালো পাওয়া যায়।
তবে চাষিরা জানান, গত কয়েক বছর বিদেশ থেকে প্লাস্টিকের ফুল আমদানি হওয়ায় কাঁচা ফুলের দাম একটু কমে গেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাঁচা ফুলের পাশাপাশি প্লাস্টিকের ফুলও ব্যবহার করা হচ্ছে। তাঁরা বলেন, প্লাস্টিকের ফুল আমদানি কমিয়ে সরকার ফুলচাষে পৃষ্ঠপোষকতা করা দরকার।
এদিকে মাঠে ফুল তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে নারী, শিশু ও পুরুষ শ্রমিকরা। দল বেঁধে একঝাঁক শিশু গাঁদা ফুল তুলে বস্তাভর্তি করে যাচ্ছে। তারা জানায়, তাদের পরিবারে অভাব নিত্যদিনের সঙ্গী। সবাই আবার স্কুলেও যায়। স্কুল শেষ করে এসে পরিবারকে একটু সহযোগিতা করতে প্রতিদিন তারা কয়েকজন মিলে দল বেঁধে বস্তা নিয়ে ফুল তুলতে আসে। প্রতি বস্তায় ফুল ভরে মজুরি হিসেবে পায় ১৫ থেকে ২০ টাকা। এভাবে শিশুরা দৈনিক আয় করে ৩০-৪০ টাকা।
সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শোয়েব মাহামুদ জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কম বেশি ফুলচাষ হয়। তবে খাগরিয়ায় ব্যাপকভাবে ফুলচাষ হচ্ছে। চরখাগরিয়ার কয়েক শ কৃষক ফুলচাষে জড়িত। এখানকার কৃষক চন্দনাইশের জাফরাবাদ এলাকায়ও ফুলচাষ করেন।
তিনি বলেন, ‘ফুলচাষ করে কৃষক বেশ লাভবান হচ্ছেন। শুধু ফুলচাষ করেই অনেক কৃষকের পাল্টে গেছে জীবন। অনন্য ফসলের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় কৃষক দিনদিন ফুলচাষে ঝুঁকে পড়ছেন। এখানে বিভিন্ন জাতের ফুলচাষ হয়। ’
চট্টগ্রামে ফুলের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি চরখাগরিয়াতে ফুলের চাষ হয়েছে প্রায় ২৫ একর জমিতে।