২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৪ এএম |
ডেস্ক রিপোর্ট :
চীন থেকে আমদানি করা ডেমু ট্রেন দেশের রেলপথে চলাচল শুরু করে ২০১৩ সালে। ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট ট্রেনগুলোর সংক্ষেপ নাম ডেমু ট্রেন। ৬৫৪ কোটি টাকায় কেনা ২০ সেট ডেমু ট্রেনের ১৮ সেট এখনই অচল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থ নয়ছয়ের বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে থেকে গেছে ‘ডেমু ট্রেন’। বিকল অকেজো হয়ে ট্রেনগুলো পড়ে আছে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রেলওয়ের স্থাপনায়। ট্রেনগুলোর কোনোটির চাকা সচল নেই, ভেঙে গেছে জানালা। কোনো ট্রেনের জানালার কাচও অবশিষ্ট নেই। ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে আছে বহু আগেই। ভেতরের যন্ত্রাংশ, লাইট-ফ্যান খুলে নেওয়ায় প্রতীকী ট্রেন হিসেবেই অবশিষ্ট আছে এগুলো।
অচল ডেমু ট্রেন মেরামত, যন্ত্রাংশ ক্রয় ও জ্বালানি তেলের ব্যবহার দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি-অনিয়মের তথ্যও মেলে রেলওয়েরই একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেমু ট্রেন এখন জাদুঘরে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অথচ কম দূরত্বে আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য চীন থেকে আমদানি করা হয় ব্যতিক্রমী এই ডেমু ট্রেন। ট্রেনগুলোর সামনে-পেছনে দুই দিকেই আছে ইঞ্জিন। স্বল্প দূরত্বে দ্রুত চলাচলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রেনগুলো রেলওয়েতে সংযোজন করা হয়। কেনার সময় চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি ছিল টানা ২০-২৫ বছর ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু ২০১৩ সালের মাঝামাঝি ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করার পরপরই যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। এরপর থেকে নানা যান্ত্রিক ত্রুটি লেগেই ছিল ২০ সেট ট্রেনে। চলাচল অযোগ্য এসব ট্রেনে আয়ের চেয়ে মেরামত খাতে ব্যয় বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ২০১৯ সাল থেকে ডেমু ট্রেনে যাত্রী পরিবহন সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, ২০ সেট ডেমু ট্রেন আর কখনো চালানো সম্ভব নাও হতে পারে। এসব ট্রেন মেরামত করে চালাতে গেলে ব্যয় বেশি হবে। সে তুলনায় আয় না হলে আর মেরামত করে তো লাভ নেই। এরপরও মেরামতের ব্যাপারে কারিগরি দিক পরীক্ষা করে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
ডেমু ট্রেন না চালিয়ে জ্বালানি খাতে ব্যয় দেখানোর পাশাপাশি যন্ত্রপাতি কেনা নিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ধরনের নীরিক্ষা হতে পারে। তবে বিষয়টি নিয়ে আমি অবহিত নই।
রেলওয়ের মেকানিক্যাল বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০ সেট ডেমু ট্রেনের মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী লোকোশেডে আছে ১০ সেট। আট সেট ডেমু ট্রেন ঢাকার কমলাপুর লোকোশেডে, দুই সেট ডেমু ট্রেন পার্বতীপুর লোকোশেডে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের লোকোশেডে থাকা ১০ সেটের মধ্যে এক সেট সচল আছে। আর ঢাকার লোকোশেডে থাকা এক সেট ডেমু ট্রেন সচল আছে। ঢাকার সচল ডেমুটি চলত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে। চট্টগ্রামের ডেমুটি চলত চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেলপথে। দুটি ট্রেন পরিচালনার জন্য লোকোমাস্টার বা এলএম নেই। নেউ গার্ড ও ক্রু। তাই দুই সেট ডেমু ট্রেন কারিগরিভাবে সচল থাকলেও চালানো যাচ্ছে না।
রেলওয়ে কারিগরি পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কুদরত ই বারি খোকন বলেন, ২০ সেট ডেমুর ১৮ সেট অচল। অকেজো হয়ে পড়ে আছে পাহাড়তলীতে অবস্থিত রেলওয়ের লোকোশেড, ঢাকা ও পাবর্তীপুর লোকোশেডে। এসব ট্রেন যাচাই-বাছাই না করেই কেনা হয়। আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগী নয়। ট্রেনগুলো কিনতে ৬০০ কোটির বেশি টাকা ব্যয় হয়।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, ডেমু ট্রেন বাবদ এ পর্যন্ত যা আয় হয়েছে তার চেয়ে মেরামত খাতে ব্যয় বেশি। ট্রেনগুলো বন্ধ থাকা অবস্থায় যাত্রী পরিবহন খাতে আয় সম্পূর্ণ বন্ধ থাকত। আর এই সুযোগে রেলওয়ের দুর্নীতিবাজ একটি চক্র মেরামত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। বছর বছর মেরামত খাতে বিপুল অর্থ গচ্চা গেলেও ট্রেনগুলো শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়েই গেছে। রেলওয়ের পাহাড়তলী কারখানা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, মেরামত বাবদ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪০ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ডেমুর জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ কেনা বাবদ ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪১ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। দুই অর্থবছরে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ৭৮১ টাকা ব্যয় হলেও কোনো কাজে আসেনি। অথচ ট্রেনগুলো এক দিন চললে তিন দিন বন্ধ থাকত। চট্টগ্রাম-নাজিরহাট ও চট্টগ্রাম-বিশ্ববিদ্যালয় রেলপথে চলাচল করলেও বহু দিন থেকে বন্ধ। একসময় চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে চলাচল শুরু করলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ট্রেনগুলোর বড় অংশ মেরামত হতো চট্টগ্রামের পাহাড়তলী লোকোশেডে। কিছু মেরামত কাজ চলে পার্বতীপুর কারখানায়।
রেলওয়ের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ডেমুতে জ্বালানি খাতে বিপুল তেল ব্যবহার করার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চলাচল বন্ধ থাকার সময়ই দুই সেট ডেমু ট্রেনে ১ হাজার ৭১২ লিটার জ্বালানি তেল ও ৩২২ লিটার লুবঅয়েল ব্যবহার দেখানো হয়েছে। বন্ধ থাকা দুটি ডেমু ট্রেনের বিপরীতে ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৬ টাকার যন্ত্রাংশ ক্রয় দেখানো হয়। যা ডেমু খাতে বড় ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
পাহাড়তলী লোকোশেডে কর্মরত কর্মী এবং রেলওয়ে কারিগরি পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কুদরত ই বারি খোকন বলেন, বন্ধ থাকা অবস্থায় ডিজেল ব্যবহারের কথা আমরাও শুনেছি। রেলওয়ের দুই কর্মকর্তা প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও ডেমু ট্রেন কিনেছেন। তারাই অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটায় জড়িত। তারা অবসরে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
এদিকে ডেমু ট্রেন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ জুলাই সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ওই সময়ের রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বৈঠকে ডেমু ট্রেনের দেশি-বিদেশি সরবরাহকারীদের তলব করতে বলেছিল সংসদীয় কমিটি। পাশাপাশি রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) পার্থ সরকারকে সাময়িক বরখাস্ত করারও সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে কমিটির সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয়নি। এর মধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে আছেন।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ডেমু ট্রেন কেনার কারণ ছিল শতকোটি টাকা নয়ছয় করা। শীতপ্রধান দেশের এই ট্রেন কেনা হয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশের রেলপথে চালানোর জন্য। এ ধরনের একটি প্রকল্প না নিলে টাকা আত্মসাৎ করা যেত না। প্রথমেই এই ট্রেন কেনাকাটায় যারা জড়িত ছিল তাদের তদন্তের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা দরকার। এরপর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন।
ডেমু ট্রেনের পেছনে নানা খাতে ব্যয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ট্রেন চলেনি অথচ জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়েছে এ ধরনের দুর্নীতির খবর আমরা শুনেছি। পুরো বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করলে দুর্নীতিবাজরা শাস্তির আওতায় আসবে।