২:০৪ পিএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, সোমবার | | ১৮ শা'বান ১৪৪৬




কতটা পেরেছি নারীর অধিকার দিতে?

১৮ মার্চ ২০২০, ০৬:২১ পিএম |


আজহার মাহমুদ:  নারী।  শব্দটা সহজ একটি শব্দ।  তবে বিশ্লেষণ ততটা সহজ নয়।  এটা খুব মমতার শব্দ।  নারী মানেই মা, নারী মানেই একজন পুরুষের প্রেরণা। 

নারী মানে বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নাম।  নারী মানে অদম্য এক সাহসের নাম।  এই নারী নামটাই অনেক ওজনদার।  যা আমাদের কাছে সহজ সহজ মনে হয়। 

আসলে আমরা নারী মানে কি বুঝি? এ প্রজন্ম, এ দেশের মানুষ, এ বিশ্ব নারীকে কতটা বুঝেছে? আচ্ছা আমি বিশ্ব নিয়ে আলোচনা কিংবা বলার মতো জ্ঞানী নই।  তবে আমাদের সমাজ, দেশ নারীকে কতটা বুঝে সেটাই বলি।  খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে এখনও আমাদের সমাজ নারীকে ভোগের দৃষ্টিতেই দেখে।  নারী মানে এখনও কামনা-বাসনা পূর্ণতার মাধ্যম ছাড়া এ সমাজ আর কিছুই বুঝে না।  বলতে লজ্জা হলেও এটাই বাস্তবতা।  তা না হলে এ সমাজে এখানও দৈনিক দু-চারটা করে ধর্ষণ হতো না।  আসলে এর চেয়ে বেশি নারীকে নিয়ে ভাবার মানসিকতাই আমাদের ভেতর এখনও তৈরী করতে পারিনি। 

এই যেমন খেলার মাঠ থেকে এভারেস্ট।  সর্বত্রই বিজয় নিশান উড়াচ্ছেন বাংলাদেশের নারীরা।  আমাদের এটা নিয়ে তেমন ভাবনা নেই।  আরও সহজভাবে বিষয়টা বলি।  সম্প্রতি বাংলাদেশ নারী দল টিটুয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে অস্ট্রলিয়ায় গিয়েছিলো। 

সবকটি ম্যাচ হেরে চলেও এসেছে।  তবে এটা কেউ জানেও না।  আমি এটাই বোঝাতে চাচ্ছি আমাদের চিন্তায়, চেতনায় নারীরা নেই।  নেই মানে নেই।  অথচ আমরা পুরুষদের খেলা নিয়ে ঠিকই উন্মাদ থাকি।  সামান্য জিম্বাবুয়ের সাথে খেলা হচ্ছে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।  অথচ একদিকে বাংলাদেশের নারী দল বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে শেষ করে চলেও এসেছে কারও কোনো খবর নেই।  নেই কোনো আলোচনা, নেই কোনো সমালোচনা।  এরপরও আমরা একদল বলি নারীর অধিকার, নারীর সম্মান এদেশে পর্যাপ্ত আছে। 

প্রতিবছরের ন্যয় এবছরও আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিয়ে কর্মসূচি চলছে।  নারী দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য- ‘প্রজন্ম হোক সমতার : সকল নারীর অধিকার’।  এছাড়া সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি ধর্ষণসহ সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধ কর’।  নারীর অধিকার তো কতটা দিতে পারছি তা উপরেই বলেছি।  আর নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ! এটা তো আকাশ-কুসুম বিষয়। 

এই ধর্ষণ রোধে এ পর্যন্ত কত কি হয়েছে তা বলতে গেলে লেখাটি শেষ হবে না।  মনে হয় পাঠকদেরও এ বিষয়ে বেশ জানা আছে।  তবুও আরও একবার জানিয়ে দিই।  শুধুমাত্র পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৪০০টি।  এ তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১ লাখ নারী-নারীর মধ্যে প্রায় ৪ জন নারী-শিশুকেই ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে, যা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। 

এরপরেও নারীরা থেমে নেই।  হার না মানা অদম্য শক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে।  নিজের সর্বশক্তি আর সাহস দিয়ে অর্জন করছে সফলতা।  সব জায়গায় পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকছে এবং বিজয়ও ছিনিয়ে আনছে।  ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, লিঙ্গসমতা দূর করার দিক থেকে বাংলাদেশ এশিয়ায় দ্বিতীয়।  বর্তমানে কৃষি, সেবা ও শিল্প খাতে কাজ করছেন ২ কোটি নারী।  রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ষষ্ঠ।  সংসদেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। 

দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী, নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ১৪৪টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম।  বর্তমানে বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মানবাধিকার কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা।  এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সমীক্ষা অনুযায়ী কর্মজীবী পুরুষের তুলনায় কর্মজীবী নারী কাজ করেন তিনগুণ।  দেশের অভ্যন্তরে অর্থনীতির মূল কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান ক্রমাগত বাড়ছে।  সমীক্ষা অনুসারে, মূলধারার অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃত উৎপাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেকই এখন নারী। 

বিবিএসের তথ্য মতে, গত ১০ বছর কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০৮ শতাংশ।  আর পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে ২ শতাংশ।  চিংড়ি, চামড়া, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, চা ও তামাক শিল্পসহ অন্যান্য পণ্যের মোট রপ্তানি আয়ের ৭৫ শতাংশ অর্জনের মূল চালিকাশক্তিই নারী।  পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪০লাখ কর্মীর মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী।  বাংলাদেশের পুরুষের পাশাপাশি বৈশ্বিক শ্রমবাজারে নারীরাও কাজ করছে।  এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশি নারী কর্মরত আছেন।  সরকারি সংস্থা বিআইডিএসের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, জিডিপিতে কর্মজীবী নারীদের অবদান ২০ শতাংশ।  বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে ব্যাংক খাতে ১২ শতাংশ নারী কাজ করেন।  ২০১৭ সাল শেষে ব্যাংক খাতে কর্মচারী ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার ২৭ জন, এর মধ্যে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থাত্ ২২ হাজার ৫৩ জন নারী। 

এছাড়াও নারীদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতেও সহায়ক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।  মাতৃত্বকালীন ছুটি তিন মাস থেকে দুই ধাপে ছয় মাস করা, সন্তানের পরিচয়ে বাবার সঙ্গে মায়ের নাম যুক্ত করা, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে ছেলের পাশাপাশি এক জন নারী উদ্যোক্তা নিশ্চিত করা, মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে ‘তথ্য আপা’ প্রকল্প চালু, নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প, নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্প, অতি দরিদ্র ১০ লাখ মহিলার দক্ষতা উন্নয়ন ও কারিগরি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া, নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা দেশে বিক্রির জন্য নারীবান্ধব বিপণন নেটওয়ার্ক ‘জয়িতা’ গড়ে তোলা হয়েছে। 

এ ছাড়া তৃণমূলের নারীদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।  দেশব্যাপী ১২ হাজার ৯৫৬টি পল্লী মাতৃস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মা ও শিশুর যতœসহ যাবতীয় বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ ও সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হচ্ছে। 

এভাবেই শত বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাবে নারীরা।  নারীদের এগিয়ে যেতে হবেই।  সরকারের পাশাপাশি নারীদের সহযোগিতা করতে হবে পুরুষদেরও। 

আমরা যদি নারীদের প্রতিপক্ষ না ভেবে মানুষ ভাবি তবেই একসাথে কাজ করতে পারবো।  মনে রাখতে হবে, দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ।  জয় হোক নারীর, জয় হোক সাম্যের। 

লেখক: আজহার মাহমুদ. প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক। 


keya