এম.শাহীদুল আলমঃ কর্মস্থল-নানুপুর গাউছিয়া ফাযিল ডিগ্রি মাদ্রাসা।
একদিন হঠাৎ সিদ্ধান্ত হলো আমাদের মাদরাসার আরবি মোদ্দারিছ্ তসলিম উদ্দিন আল্ কাদেরী সাহেবের "প্রাইভেট কারে" করে আমরা কয়েকজন শিক্ষক "কুতুবদিয়া সফরে"-যাবো,সাথে সাথে আমিও যাওয়ার জন্য সম্মতি জানাই।
সেইদিন " সোমবার " ১৯-০৮-২০১৯ ইংরেজি। সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলো তসলিম সাহেব,নোমান সাহেব, শাহীদ সাহেব ও আমার এলাকার বড় ভাই যিনি কারটি ড্রাইভ করেছিলেন নাসির ভাই। আমাদের কারো কুতুবদিয়া যাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলোনা।
সিদ্ধান্ত হলো একজন নাস্তার আরেকজন ভাতের ব্যবস্থা আর তসলিম সাহেবের গাড়ি ফ্রী এইভাবে প্লানিং ছিলো সফরকাল।
সকালে মাদ্রাসায় চিরনিদ্রায় শায়িত দুইজন প্রখ্যাত আলেমেদ্বিনের মাজার জেয়ারত শেষে কুতুবদিয়ার পথে যাত্রা শুরু করি। সফরসঙ্গী তাসলিম সাহেব ও নাসির ভাই দুজনেই চমৎকার হাস্যরসের, সমস্ত পথজুড়ে আনন্দে মাইলের পর মাইল পথপাড়ি দিচ্ছি। তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর পর আমাদের মধ্যে কেউ আর কুতুবদিয়া কিভাবে যাবে তা জানা নেই।
একের পর এক রাস্তায় চলমান সেখানকার পথিকদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া কুতুবদিয়া যাওয়ার ঘাটের পথ কোনটি? একজন বলে সোজা যেতে থাকেন তারপর ডানে জিজ্ঞেস করলে হবে।
এইভাবে কয়জনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে হিসাব নেই। অবশেষে ঘাটে যাওয়ার পথের সন্ধান মিলে। ঘাটের নাম "মগনামা ঘাট"। সেই ঘাটে দ্বিতীয়বারের মতো নাস্তা করি তারপর বোটে উঠে পড়ি আর সেই বোটে দেখা মিলে আমার বহুবছরের পুরনো বন্ধু যে কিনা আমার সাথে চারবছর ডিপ্লোমা পড়েছে। প্রথম দিকে সে আমায় চিনতে না পারলেও আমি কিন্তু ঠিকই চিনতে পেরেছি বন্ধু " মোজাম্মেল"-কে।
সেও শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। সাগর আমার প্রচন্ড ভয় লাগে তারপরও যাওয়ার সময় কোনো সমস্যা হয়নি পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত সেই "কুতুবদিয়া"। ঘাটের উপার হতে টেম্পুযোগে " মুজাদ্দিদে আখেরুজ্জামান, মুসলিহ আজম, গাউছে মোক্তার,মালেক আল্-কুতুবী মুহিউদ্দীন আজমী (রঃ) এর মাজার শরীফে পৌঁছায়।
সেখানে দুপুরের নামাজ আদায় করে জেয়ারত শেষে "মাটির হানকে" করে দস্তার খানায় লাইন ধরে ছোট চিংড়ি দিয়ে তাবারুক গ্রহন করি। শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে তবারুক গ্রহণ করতে বলে কোনো আওয়াজ নেই নিস্তব্ধ চারিদিকে। পরিবেশটা অন্যরকম অনুভূত হয়।
তারপর কুতুব শরীফ দরবারের গদিনশীন ও পরিচালক - আলহাজ্ব শাহজাদা শেখ ফরিদ আল্ কুতুবী (মা.জি.আ.) এর সাথে একযোগে সবাই সৌজন্য সাক্ষাৎ-এ মিলিত হই আর উনি আমাদেরকে কোন জায়গা থেকে এসেছি? মাদ্রাসার নাম কি? প্রিন্সিপাল কে? এক এক করে সব প্রশ্নের উত্তর দি,,,,সবাইকে কোমল পানীয় পান করার পর সবাইকে উনার ব্যক্তিগত ভিজিটিং কার্ড প্রদান করে।
মাসিক ফাতেহা শরীফ প্রতি চন্দ্র মাসের ১২তারিখ এবং বার্ষিক ফাতেহা শরীফ প্রতি বছর ৭ই ফাল্গুন (১৯শে ফেব্রুয়ারী) কুতুব শরীফ দরবারে অনুষ্ঠিত হয়। খুব ভালো লাগলো শাহজাদা সাহেব ব্যক্তিগত ফোন নাম্বার দিয়ে বলেম যেকোন বালা-মুসিবতে পড়লে ফোনো যোগাযোগ করার জন্য।
(০১৭১৩৬৩১২৭৯). শুকরিয়া জানিয়ে গ্রহন করি। এইবার কুতুবদিয়া বাতিঘর-বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও দর্শনীয় স্থান দেখার জন্যে দুটি অটো রিকশা ভাড়া নিয়ে ঘুরতে লাগলাম শেষমেশ তেমন কিছুই দেখা হলোনা,,,বাতিঘরটিও জীর্ণশীর্ণ।
তবে দ্বীপে এসে সাগরের পূর্ব-দক্ষিণ দিক দেখা হলো। এবার বাড়ী ফেরারক্ষণ অবশেষে ঘাটে এসে বোটে বসলাম সকলেই সব মিলিয়ে ৩০-৩৫ হবে কিছুক্ষণ চলার পর হায়! আল্লাহ কি যে সাগরের ঢেউ পুরো বোটে পানির ঝাপটা একদিকে পুরাই কাত হয়ে যাচ্ছে খুব ভয়ানক পরিস্থিতি।
সবাই আল্লাহকে স্মরণ করছে আমরাতো রীতিমতো ভয়ই পেয়ে গেলাম আর মনে মনে সব দোয়া-দরুদ পড়ে ফেললাম। যতই গভীরে যাচ্ছে ততই টেনশনে ভুগছি এখন বোট উল্টে গেলে সাঁতার দিয়েও তো কুল-কিনারা পাবোনা।
কোনো কুল কিনারা দেখছিনা। স্থানীয় যাঁরা তাদের মনে সাহস আছে তবে তারাও সেদিন চিন্তিত কখনো এমন হয়নি ঢেউয়ের সাথে সাথে চললো বোট, আল্লাহর মেহেরবানীতে ঘাটে এসে পৌঁছলাম। বাসায়ও ফোন দিয়ে জানায়নি এমন বিপদে পড়ার মুহূর্তের কথা।
তখন শুধু আমার দেড় বছরের একমাত্র সন্তান "আরহামের"- কথা মনে পড়ছিলো বেশি বেশি, বাকিরাতো আছেই। এই গেলো প্রাণে বেঁচে যাওয়ার প্রথম মুহূর্ত। আসার পথে একটি রেস্তোরাঁয় আমার পক্ষ থেকে নাস্তার আয়োজন সেড়ে নতুন ব্রীজের আগেই দ্বিতীয় মৃত্যু খুপে পড়লাম তখন রাত ০৮ঃ০০ টার মতো চারিদিকে গাড়ির গ্লাস ভাঙছে,দিকবিদিক গাড়ির ছুটাছুটি, তুপের মুখে পড়লাম আমাদের গাড়িসহ,,,,কোন ভদ্রলোক জানিনা তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরাও বলে চিৎকার দিয়ে ইশারা করলো তৎক্ষনাৎ আমাদের গাড়ি চালক নাসির ভাই দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য লাইনে আবার ৩-৪কিলোমিটার পেছনে চলি আসি।
শুনতে পায় কোন এক পেয়ারা বিক্রেতাকে পেয়ারার দাম বেশি বলায় ডিবি পুলিশ তার বুকে লাতি মারায় ঐ ব্যবসায়ী মৃত্যু বরণ করেন সাথে সাথে রাস্তা ব্লক আর গাড়ি ভাঙচুর।
দীর্ঘ ৩-৪ঘন্টা পর চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে আর আমরা বাড়ির পথে পুনরায় যাত্রা করি এই গেলো কুতুবদিয়া সফরের ভয়ানক দিন।
মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় সহিসালামতে মায়ের কোলে ফিরে আসি আর প্রিয় পুত্রকে বুকে জড়িয়ে রাখি আর প্রিয়জনকে ধীরে ধীরে এমন ভয়াল মুহূর্তের কথা শেয়ার করি।