৪:৪২ পিএম, ৪ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার |
| ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫
ফারজানা মিতু
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল। অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত দোলা হোস্টেল ছেড়ে বাড়িতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এঁকে এঁকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্কুল-কলেজ। এখন রাস্তাঘাটে বের হতে মানুষ ভয় পায়। পাকিস্তানি মিলিটারির জিপ এখানে-সেখানে দেখা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে ঢাকা শহরে কারফিউ শুরু হয়ে যাবে। দোলা ছোট একটা ব্যাগে কিছু কাপড় গুছিয়ে নেয়। ঢাকায় ওর নিজের কেউ নেই, এক মামা ছাড়া। মামাকেও কল দিয়েছিল; কিন্তু মামি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ওনারা কোনো ঝামেলা এসময় নিতে চায় না। বাড়িতে মা আর ভাই হয়তো চিন্তা করছে দোলা এখানে নিরাপদেই আছে; কিন্তু দোলা জানে কতটা শংকা আর বিপদের মুখে এখানে আছে। সেদিনও হোস্টেলের দু’জন মেয়েকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। এখানে থাকলে প্রতি মুহূর্তে যে ভয় সেটা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় গ্রামে যাওয়া। যেখানে দোলা সম্পূর্ণ নিরাপদ। ঢাকা থেকে বগুড়া খুব একটা দূর নয়। চেষ্টা করলে পৌঁছে যেতে পারবে। সন্ধ্যার পরপরই দোলা একটা বোরকা পরে বের হয়ে পড়ে। নিউমার্কেটের সামনেই ওর পথ আগলে দাঁড়ায় কিছু মিলিটারি। দোলাকে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছে, সঙ্গে কে আছে। দোলা ভয়ে আরও সংকুচিত হয়ে যায় বোরকার নিচে। আর তখনই মাথায় টুপি দেয়া এক বৃদ্ধ এগিয়ে আসে। তুম ইধার? আও আও মেরে সঙ্গে আও। হুজুর এ মেরি বিবি হে।
ওহ তুমাহারা বিবি? লে যাও। বৃদ্ধ লোকের বউ বৃদ্ধাই হবে এই ভেবে ওরা আর দাঁড়ায় না। ওরা চলে যেতে বোরকার নিচে দোলা কান্নায় ভেঙে পড়ে। বৃদ্ধ এগিয়ে এসে হাত রাখে দোলার মাথায়। কেঁদো না মা। তুমি কই যাবা, একা বের হওয়া ঠিক হয়নি।
চাচা আমি গ্রামে যাব। আমার হোস্টেলে থাকা নিরাপদ না।
মারে হোস্টেলে নিরাপদ না; কিন্তু রাস্তায় আরও ভয়। একা এতদূর কেমনে যাবা? বৃদ্ধ কিছুক্ষণ ভাবে, মা চলো আমি তোমাকে গ্রামে দিয়ে আসি। তুমি আমার মেয়ের মতো, এভাবে তোমাকে বিপদের মুখে ছেড়ে যাই কেমনে? দেখি চলো, সামনে কিছু পাই কিনা। কারফিউ শুরু হবে ১০টায়। এখনও সময় আছে, অনেক দূর চলে যাওয়া যাবে। তাড়াতাড়ি পা চালাও মা। এই নাও হাতে এই তজবিহ রাখ। দোলার নিজের বাবার কথা মনে হয়ে যায়। বাবা থাকলে এভাবেই বলত। কখনও ভ্যানগাড়িতে, কখনও ঠেলাগাড়িতে করে আর নিজের বিবি পরিচয় দিয়ে বাবার মতো মানুষটি দোলাকে গ্রামের কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে গেল। চাচা আপনার ঋণ কখনও শোধ দিতে পারব না।
বাবার ঋণ শোধ করতে হয় না মা। সন্তানের ঋণ এমনিতেই মাফ হয়ে যায়। যাও মা, সাবধানে থেকো।
চাচা আমি এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ। এটা আমার নিজের জায়গা, আমি এখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি। আসি চাচা।
যাও মা। ফি আমানিল্লাহ।
দোলা যেতে যেতে ফিরে তাকায়। কত সহজে দোলাকে বাঁচাতে নিজের বিবি বলে পরিচয় দিয়েছে এ বৃদ্ধ। দোলা একসময় পৌঁছে যায় নিজের বাড়িতে। উঠানে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মা, ও মা।
দোলার ডাক শুনে সফুরা বের হয়ে আসে। দোলা? মা তুই কেমনে আইলি?
সে অনেক কথা চলো ভেতরে যাই। ভেতরে যেয়ে দোলা সবকিছু খুলে বলে। কী সর্বনাশ, আমরা আরও ভাবছি তুই হোস্টেলে নিরাপদ।
নাহ মা, লোকজন দলে দলে গ্রামে এসে আশ্রয় নিচ্ছে।
কী কস এটা? গ্রামে আইবো কেন? আমাদের পাশের গ্রামে মিলিটারি ক্যাম্প করছে। তোর দবির চাচা শান্তিবাহিনীর মেম্বার হইছে।
এটা কী বললা মা? চাচা শান্তিবাহিনীতে যোগ দিছে? এটা চাচা কেমনে পারল? মা, ভাইজান কই?
সফুরা কাঁদো কাঁদো ভাবে বলে, দীপন মুক্তিবাহিনীতে নাম দিছে।
কী বলো মা, সত্যি? আমার যে কী খুশি লাগতেছে। আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা। বাপজান থাকলে কী খুশি হতো।
পরেরদিন রাতে কে জানি এসে দরজায় আস্তে আস্তে টোকা দেয়। চাচি, ও চাচি। সফুরা ভয়ে ভয়ে দরজা খোলে। পাশের গ্রামের কুদ্দুস, দীপনের বন্ধু। কিরে কুদ্দুস তুই এই সময়, কী হইছে?
চাচি, আমারে দীপন পাঠাইছে। কিছু চিড়া, গুড় আর মুড়ি দিতে কইছে। খুব কষ্ট হইতেছে আমাগো খাবারের।
তুই একটু দাঁড়া, আমি ঠিক কইরা দিতেছি সব। কুদ্দুস ভাই তোমরা কই ঘাঁটি বানাইছো?
আমরা আমাগো পুরাণ মন্দিরে আছি। ওইখানে সাপের ভয়ে কেউ যাইবো না খুঁজতে।
কুদ্দুস ভাই, তুমি এখানে আর থাইকো না। কী থেকে কী হয়, তুমি বরং যাও, খাবার আমি পৌঁছায় দিমু।
কি রে কুদ্দুস কই গেল দোলা?
মা এখানে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ না তাই কুদ্দুস ভাই চইলা গেল। পরে আমি দিয়ে আসব।
তুই কেমনে দিবি?
আছে তুমি বুঝবা না। ভোরবেলা মা ওঠার আগে দোলা একটা চিঠি লিখে চলে যায়। মা, আমি ভাইদের মতো যুদ্ধে গেলাম, দেশের জন্য লড়াই শুধু ছেলেরাই করবে কেন মা? আমরাও কি পারি না দেশের জন্য কিছু করতে? মেয়ে বলে কী পিছিয়ে থাকব? দোয়া করো মা। ”
ভাইয়ের কোনো নিষেধ মানতে চায় না দোলা। ভাইয়ের সঙ্গে নেমে পড়ে যুদ্ধে। সালওয়ারের ওপর ভাইয়ের শার্ট আর কোমর পেঁচিয়ে পরা ওড়না। কাঁধ ছাড়িয়ে পড়া চুল বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই কেটে নিয়েছিল ছেলেদের মতো। প্রথম মিশন শেষ করতে ওদের কোনো বেগ পেতে হয়নি। একজনের পায়ে গুলি লাগে শুধু আর মারা যায় পাঁচজন পাকসেনা। পরের দিন আবারও পাকসেনাদের সঙ্গে গোলাগুলির একপর্যায়ে সঙ্গের রমিজ আর খসরুকে বাঁচাতে ধরা দেয় দোলা। এরা ধরা পড়লে এঁকে এঁকে ধরা পড়বে দলের সবাই। দোলা মেয়ে মানুষ, সব কষ্ট সহ্য করতে পারবে; কিন্তু ভাইদের কোনোভাবেই ধরিয়ে দেয়া যাবে না। ক্যাম্পে শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। পালাক্রমে ধর্ষণ হয় দোলা। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারায়; কিন্তু তাতে থেমে থাকে না ওরা। বিবস্ত্র করে ওকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। নানাভাবে বের করার চেষ্টা করে মুক্তিসেনাদের খবর কিন্তু দোলা অবিচল। একসময় দোলার ভেতরে লাঠি ঢুকিয়ে দেয় ওরা। দোলা জ্ঞান হারায়, রক্তাক্ত হয় তবুও মুখ খুলে না। দুইটা মাস এই ক্যাম্পে থাকার পর ওকে নিয়ে যাওয়া হয় আরেক ক্যাম্পে। একদিন যখন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পায় তখন দোলা সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ওর ভাই ফিরে আসে আহত অবস্থায়। দোলার এ অবস্থায় বাড়ি ফেরা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না ওর মা। বলে যেভাবেই হোক পেটের পাপ নষ্ট করতে হবে।
দোলা রাজি হয় না। মা, আমার সঙ্গে যেটা হয়েছে সেটা অন্যায় কিন্তু এ সন্তান পাপ নয়। ওকে যদি পাপ বলি তাহলে এই যে আমার আত্মত্যাগ সেটাকে ছোট করা হয়। যেভাবেই হোক এই সন্তান এখন আমার। আমি ওর চলাফেরা সব টের পাই। সে আমাকে মা বলে ডাকে। আমি কীভাবে ওকে নষ্ট করি? আমি পারব না, মা। গ্রামের লোকের কথা থেকে বাঁচতে একদিন গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে দোলা। বারবার কানে বাজে মায়ের শেষ কথা এই সন্তানের পরিচয় যেন আমাদের নামে না হয়।
স্বাধীন দেশে জন্ম নেয় দোলার ছেলে। ছেলের মুখ দেখে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে দোলা। সব অপমান, সব কষ্ট নিমেষে মুছে যায় মন থেকে। ছেলের দিকে তাকিয়ে দোলা বলে, তুই আমার সন্তান, বাংলাদেশ তোর দেশ। এটাই তোর একমাত্র পরিচয়।
নার্স এসে দোলাকে বলে, এই মেয়ে তোমার সন্তানের বাপের নাম কী? এখানে কাগজে লিখতে হবে। তোমার পরিচয় আর বাপের নামও লিখতে হবে।
আমার সন্তানের বাপ আর মা আমি নিজেই আর আমার কোনো পরিচয় নেই।
তাহলে কী ৩২ নম্বর লিখে দেব?
বুঝলাম না।
জানো না, শেখ মুজিব বলে দিয়েছেন যাদের কোনো পরিচয় নেই, তাদের ঠিকানা ৩২ নম্বর আর তাদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।
দোলা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। দোলা আর পরিচয়হীন নয়। এই দেশের যিনি পিতা, তিনি দোলারও পিতা। দোলা শুধু বীরাঙ্গনাই নয়, একজন মুক্তিযোদ্ধাও। ছেলেকে বুকে নিয়ে দোলা বেরিয়ে পড়ে মাথা উঁচু করে। শেখ মুজিবের সন্তানরা মাথা নিচু করতে শিখেনি। এই দেশ তাদের বাবার, এই দেশ অনেক দামে কেনা।
সম্পাদনা : চৌধুরী-২১/এসএনএন-১৪ ডিসেম্বর ২০১৬