৪:৩৩ পিএম, ৪ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার |
| ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫
বিপ্লবী অভিনন্দন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে বিশ্বের সকল শ্রমিকদের। মহামারি পরবর্তী
বাংলাদেশ সহ বিশ্বের কাছে 2022 বর্যের মহান মে দিবস খুবই তাত্পর্য বহন করে । করোনায় পৃথিবীর প্রায় সব দেশ অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত। প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব দেখে অনেকে বাংলাদেশ নিয়ে ও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরে গণমাধ্যমে বলেন "এ ধরনের আশঙ্কার কোনো ভিত্তি নেই। বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে। শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার কোন কারণ নেই। এসব খামোখা কথাবার্তা ;অমূলক। যা বাস্তবসম্মত নয়"। দেশের খাদ্য গুদামে প্রচুর খাদ্য মওজুদ সহ নতুন শস্য কৃষকের ঘরে উঠছে। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স রেকর্ড পরিমাণ আসা অব্যাহত রয়েছে । বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুবই সন্তোষজনক। দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা এবং বৈদেশিক ঋন পরিশোধে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অনন্য ভূমিকা নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ সকল জায়গায় প্রশংসিত। মহান মে দিবসে পৃথিবীর সকল প্রান্তে অবস্থান রত বাংলাদেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সালাম জানাই।
বিশ্বের 80 টির ও বেশি দেশে সরকারি ভাবে "মে দিবস" পালিত হয়। আবার কিছু দেশে বেসরকারি ভাবে পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের বৃহত্তম শ্রম বাজার তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে "মে দিবস" কিংবা "আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস" নিয়ে কোন আগ্রহ নাই । বাংলাদেশ সহ বহু দেশের দক্ষ অদক্ষ নারী পুরুষ এসব দেশে কাজ করে।
বিদেশি শ্রমিক নির্ভর এসব দেশে কাগজে কলমে কিছু শ্রমিক আইন থাকলেও তা শ্রমিকদের স্বার্থে আসা নিয়ে শ্রমিকদের অহরহ অভিযোগ। অল্প সংখ্যক মালিক শ্রমিকবান্ধব হলেও অধিকাংশ পুরো বিপরীত। আরবের এসব দেশ আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইনের কোন তোয়াক্কা করে না। ব্যক্তিগত কাজে নিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যযুগীয় কায়দায় দাসদাসীদের মত দিনরাত খাটায়। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কিছুটা নিয়ম মেনে কাজ করতে দেখা যায়। অনেকে শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে খালি হাতে ফেরত পাঠায়। সৌদিয়ায় সরকারি হাসপাতালে শ্রমিকদের ফ্রী চিকিৎসার সুযোগ নাই । শুধুমাত্র কয়েক ধরনের পেশার শ্রমিকদের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া যায় । মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকদের এরকম অমানবিক বৈষম্য নিয়ে কথা বলার কোথাও কোন সুযোগ নাই। তাই "আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা"(ILO) সহ শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের এখানে তদারকি থাকা দরকার। না হলে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শ্রমিকরা মানষিক বিপর্যস্ত হয়ে যাবে।
মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় নারী শ্রমিক । অভিযোগের মধ্যে দিনরাত খাটুনির পর খেতে না দেওয়া, শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন সহ যৌন নিপীড়নের শিকার অধিকাংশ নারী শ্রমিক । মরুভূমির প্রচন্ড গরমে অনেক গৃহকর্তা ফেন কিংবা এসি ব্যবহারে বারণ করে। অনেক নারী শ্রমিক এসব অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তিন চার মাসে মানষিক বিকারগস্ত হয়ে দেশে চলে আসে । সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা যৌন নিগ্রহের স্বীকার, যা আজ ওপেন সিক্রেট । নির্যাতনের স্বীকার কেউ কেউ মালিকের বাড়ি থেকে পালিয়ে আশ্রয়ের খুঁজে নিকটস্থ থানায় গেলে ও রেহাই নাই। পুলিশ তাদের মালিকের কাছে ফিরে যেতে বাধ্য করে। ইচ্ছে থাকার পরও নানান প্রতিবন্ধকতায় দেশে ফিরে আসতে ব্যর্থ হয় এরা। এসব দেশে মানবাধিকার সংগঠন কিংবা মুক্ত সাংবাদিকতার সুযোগ না থাকায় শ্রমিক নিগ্রহের কথা তেমন উঠে আসে না। এসব অভিযোগ নিয়ে আমাদের দেশের দূতাবাসের কোন সহযোগিতা পাওয়া যায় না। শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে চুক্তি সমূহ শ্রমিকবান্ধব নয়। "তাই রাষ্ট্র এসব দায় এড়াতে পারে না। শুধু রেমিট্যান্স বৃদ্ধি নিয়ে আত্মতৃপ্তি নয়, শ্রমিক দের সুযোগ নিয়ে ও ভাবা দরকার। নাহলে তরুণ প্রজন্ম বিদেশ বিমুখ হয়ে গেলে রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যা কারো কাম্য নয়।
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পাঠানো টাকায় দেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা সর্বজনবিদিত । কিন্তু দেশে কিংবা বাইরে তাদের সমস্যাবলী নিয়ে মাথাব্যাথা নেই সংশ্লিষ্টদের। পরদেশে মুখ বুঝে কষ্ট সহ্য করে পরিবারের সুখের আশায় । কিন্তু তাঁরা যখন দেশে এসে প্রতারণা সহ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তা জাতির জন্য জাতীয় লজ্জার। প্রতিদিন খবরে দেখা যায়, প্রবাসীদের রাস্তায় বেধড়ক পেঠানো,ডাকাতি, বাড়ি বেদখল, জমি থেকে উচ্ছেদ, মাস্তানদের ভয়প্রদর্শন, চাঁদাবাজি, প্রবাসী পরিবারের সদস্যদের হেনস্তা সহ ইত্যাদি চিত্র সত্যিই বেদনাদায়ক। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় দীর্ঘসূত্রীতার কারণে প্রবাসীরা প্রতিকারের জন্য প্রশাসন মূখী হতে ভয় পায়। প্রবাসীরা বিদেশে যেমন পরদেশী, তেমনি দেশেও প্রবাসীর মত দিন কাটাতে হয়। পুঁজি খোয়ানোর ভয়ে ব্যবসা করতে গিয়ে নানাবিধ বিড়ম্বনার মুখে পড়ে। প্রবাসীদের অনেক আত্মীয় স্বজন সুযোগের পথ দেখিয়ে কৌশলে বড় অংকের টাকা নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে। নানাবিধ ভয় ভীতি দিয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থে বাধা সৃষ্টি করে। প্রবাসী পরিবারকে মানষিক চাপে অতিষ্ঠ করে তুলে। প্রবাসীরা মানসম্মানের ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে এসব প্রকাশ করতে পারে না। সেই সুযোগে আত্মীয়তার মুখোশে বিশ্বাসঘাতক প্রতারক চক্র আরো হিংস্র হয়ে উঠে । তাই রাষ্ট্রের কাছে প্রবাসীদের আবেদন তাদের নিরাপদ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহ প্রশাসনিক কার্যকর সহযোগিতা। প্রশাসনে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সেল গঠন করে সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রবাসীদের সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান। প্রবাসী শ্রমিক বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে শ্রমিকবান্ধব চুক্তি। ফলে প্রবাসী বান্ধব অনুকূল পরিবেশ তৈরী হলে প্রবাসীরা দেশে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবে। প্রবাসীদের অনেক টাকা ব্যাংকে অলস পড়ে থাকে । নিরাপত্তা জনিত কারণে বিনিয়োগে ভয় পায়।
ঈদের দিন। একজন প্রবাসী শ্রমিকের সাথে তার মায়ের ফোনালাপ নিয়ে একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। অবশ্য অনেকের জানা কাহিনী।
ছেলে, "কেমন আছ মা, খুকী কেমন আছে। তার ঈদের কাপড় পছন্দ হয়েছে কিনা?
মা," বাবা তুমি কেমন আছ। খুকীর কাপড় পছন্দ হয়েছে। তুমি কিছু খেয়েছ বাবা? "।
ছেলে, "মা ঈদের নামাজ পড়ে বিরিয়ানি খেয়ে রেষ্ট নিচ্ছি মা। " আসলে ছেলেটা ঈদের দিনে ও ছুটি না পেয়ে মালিকের কাজ করছিল তখন। মা কষ্ট পাবে হিসেবে মায়ের সাথে মিথ্যা কথা বলে কেঁদে ফেললো নিজের মাঝে। এই হল অনেক প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশজীবন। ঈদ,কোরবান কিংবা মে দিবসে ও তাদের কাজের ছুটি থাকে না অনেকের। পরিবার ও দেশের মানুষের মুখে হাসি দেখলে আনন্দিত হয় তাঁরা।
প্রবাসী শ্রমিকদের রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স নিয়ে রাষ্ট্র, সরকার থেকে সাধারণ মানুষ তাদের সাধুবাদ জানাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবাসীদের প্রতি লাখ মানুষের ঈদের শুভেচ্ছায় সিক্ত রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। তখন তাঁরা সমস্ত দুঃখ ভুলে দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে । প্রবাসী কল্যাণ সমিতি কক্সবাজার জেলার সভাপতি মোঃ মোবিনুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান কুতুবী দাবি করেন,-----মে দিবসের চেতনায় প্রবাসী শ্রমিকরা ন্যা্য্য অধিকার চায়। কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় প্রবাসী এবং তাদের পরিবার নিয়মিত অত্যাচারিত হচ্ছে। তাতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির আশা করছে। তারা পরিবারের, নিজের নিরাপত্তা সহ সম্পদের সুরক্ষা চায়। পাশাপাশি সমাজের সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। যেন সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রবাসীদের নিশ্চিত নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ 1972 সালে "আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার"(ILO) সদস্য পদ লাভ করে। তাই শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে দেশে কিংবা বিদেশে ILO র হস্তক্ষেপ চায়, মহান "মে দিবসে" রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রত্যাশা।
জয় বাংলা।
----------------
লেখক --বদরুল ইসলাম বাদল
কলামিস্ট ও সমাজকর্মী
সাবেক ছাত্রনেতা।